eNewsroom India Logo

বাংলার ছোট চাষীরাও তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে

Date:

Share post:

কলকাতা: বাংলার কৃষকদের সভা-সমাবেশে ট্রাক্টর-ট্রলি বা ট্রাকের সারি দেখা যায় না যা দিল্লির সীমান্তে পঞ্জাব-হরিয়ানা বা পশিচম উত্তরপ্রদেশের বড় কৃষকদের আন্দোলনে স্বাভাবিক দৃশ্য। তবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন তিন নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে চলতি কৃষক আন্দোলনকে স্রেফ দিল্লি কে আস-পাস চলা বিরোধীদের দ্বারা বিপথচালিত আন্দোলন বলে খাটো করছেন, তখন ছোট জোতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ছোট চাষীরাও আন্দোলনের সমর্থনে পথে নামছেন।

বুধবার কলকাতায় অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির ডাকে বামপন্থী ও অন্যান্য কৃষক সংগঠনগুলির ডাকে এক সমাবেশে আসা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে সেই ছবিটাই উঠে এল। তাঁর সরকার ও দলের নেতারা এর পিছনে খালিস্তানী-পাকিস্তানী-মাওবাদী মদত খুঁজছেন, তখন আজকের মিছিল ও সভায় বাঙালি হিন্দু-মুষলমান কৃষকদের সঙ্গে পা মেলান কিছু উর্দু ও হিন্দিভাষী শ্রমজীবী নারী-পুরুষ। ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণও হলে চোখে পড়েছে।

ঐতিহাসিক ভাবে, বিশেষ করে দেশভাগের পর এই রাজ্যের কৃষিজীবীদের অধিকাংশই ছোট জমির মালিক, ভাগচাষী বা কৃষি ও অকৃষি শ্রমিক। এখানে পঞ্জাব-হরিয়ানার মতো সরকার-নিয়ন্ত্রিত মাণ্ডি ব্যবস্থা খুবই সীমিত কৃষকরা, বিশেষ করে ছোট উৎপাদকেরা বেসরকারি হাট-বাজার তথা পাইকার/ফড়ে ও আড়তদারদের উপর নির্ভরশীল। অভাবী বিক্রির সময় ধানের ক্ষেত্রে ন্যুনতম সংগ্ৰহমূল্য থাকলেও তার সুযোগ খুব কম চাষি পান। ভাঙড় থেকে আসা মধ্যবয়সী খলিল মোল্লা, শোভান মোল্লা হন বা হুগলির আরামবাগের তরুণ বিনয় দাস অথবা মালদার ইংলিশ বাজারের স্বপন সরকার, প্রতাপ মন্ডল ও মিরাজ শেখ–সবার মুখেই শোনা গেল কৃষিপণ্য বিপণনের চলতি ব্যবস্থায় ফসলের খরচ তুলে লাভজনক দাম পাওয়ার সমস্যা এবং অনেক ত্রুটি ও দুর্নীতির কথা।

কিন্তু সে সব থেকে রেহাই দেওয়ার নামে মোদি সরকারের নয়া আইনকে তাঁরা গরম কড়াই থেকে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার সামিল বলেই ভাবছেন। ফড়েরাজের বদলে কোম্পানিরাজের খপ্পরে পড়তে তারা চান না। তাই বিরোধিতায় তারা এক কাট্টা।

খলিল মোল্লারা ধান-সরষে থেকে সবজি চাষ করেন। তারা জানালেন: সার-বীজ-কীট নাশক সহ চাষের সব উপাদানের দাম বেড়েই চলেছে। অথচ ফসলের খরচ তুলতে হিমশিম। এদিকে ফসল ধরে রাখার ব্যবস্থা নেই। কলকাতার লাগোয়া ভাঙড়-হারোয়া তো বটেই, গোটা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় হিমঘর নেই বললেই চলে। পাইকাররা হয় গ্রাম থেকে তোলে নয় গাড়িভাড়া করে হাটে নিয়ে যেতে হয়। ন্যায্য দাম না পেলেও লোকসানে ছেড়ে দিতে হয় কারণ মাল পড়ে থাকলে হাট-মালিকরা ফাইন নেয়। কত বার অবিক্রিত ফসল খালে ফেলে দিতে হয়েছে।

তবু তারা নয়া আইনের ব্যবস্থায় আদানি- আম্বানিদের কব্জায় যেতে রাজি নন। বিলে তো বলছে সরকার আমাদের সুবিধে দেবে। কিন্তু কোম্পানি দাম ঠিক করবে। সরকার নিজে তো কিছু করবেই না, এমনকি কোম্পানি কথা না রাখলে কোর্টেও যেতে দেবে না। এখানকার পাইকারদের তবু চিনি। কিন্তু পাওনা আদায়ে কোম্পানির বাবুদের কোথায় খুঁজে পাব? তাছাড়া পাঁচ টাকায় যে ফসল বেচব, তাই বাজারে পঞ্চাশ টাকায় কিনতে হবে।

মোদি সরকার কৃষি আইন কিষাণ কৃষক আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গ কলকাতা বামপন্থী
নয়া কৃষি আইন রদের দাবিতে কলকাতায় কৃষকদের রাজভবন চলো অভিযানের ডাক

হুগলির আলু চাষের এলাকার ছোট চাষী বিনয় দাস অন্যের জমি লিজে নিয়ে চাষ করেন। তাঁর অভিজ্ঞতা: পেপসিকোর মতো বড় আলু-চিপস কম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে আলু চাষ করে তাঁর মতো কৃষকরা লাভবান হননি। কোম্পানি 50 কেজি বস্তায় 475 টাকা দর দিচ্ছে। আমার মতোই যাদের ফসল তুলেই মহাজনের কর্জ চুকোতে বিক্রির হন্যে হতে হয়, কোল্ড স্টোরে ফসল জমিয়ে রেখে ভালো দাম পাওয়ার আশায় টাকা লগ্নির ক্ষমতা নেই, তেমন অনেক চাষি তাই ঢলে পড়েছিল। কিন্তু ওদের মাপমতো কি মন মতো আলু না হলে ওরা ফেলে দেয়। দাম দেয় না । ওই বীজের পড়ে থাকা আলু বাজারে বিক্রি দূরে থাক, গরুতেও খায় না। ফলে লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়ে যায়।

বিনয়ের বক্তব্য: গত বার চার বিঘে জমিতে আলু লাগিয়ে বিঘে প্রতি 50000 টাকা খরচ তুলতে পারেননি। এদিকে মাঠে যে আলু দশ টাকা কেজি বেচেচেন তাই বাজারে 40 টাকা কেজি কিনে খেতে হচ্ছে। তবু মোদি সরকারের কথা মতো তিনি কর্পোরেটদের বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি জানান, স্বাধীনতার পর থেকে কৃষকদের দুরবস্থা বেড়েছে, সব সরকারের আমলেই। বেড়েছে আত্মঘাতী কৃষকদের সংখ্যা। কিন্তু কৃষি বাজারে সংস্কারের নামে মোদি সরকার নিজের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে কোম্পানীদের হাতে কৃষকদের ভাগ্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে। এরপর আমাদের জমিজমাও ওরা দখল করে নেবে যেমন ইংরেজ আমলে নীলকর সাহেবরা নিয়েছিল। কেন সরকার স্বামী নাথন কমিটির সুপারিশ মতো চাষের খরচের দেড়গুণ দাম ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য বা সহায়ক মূল্য বলে ঘোষণা করছে না?

উত্তরবঙ্গ থেকে মালদা জেলার ইংলিশবাজার থেকে আসা স্বপনবাবু, প্রতাপবাবু, মিরাজ শেখ রা জানান, তাদের এলাকার কাছে সামসিতে সরকার-নিয়ন্ত্রিত কৃষি পণ্য পাইকারিবাজার বা মাণ্ডি থাকলেও সেখানে গাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য কারণে উনি যান না। স্থানীয় বেসরকারি পাইকারদের কাছেই ধান, ভুট্টা থেকে সবজি বেচে দেন।বৃষ্টি ও অন্যান্য কারণে তো বটেই, দীর্ঘ লক ডাউনের কারণে গতবারের থেকেও এবার ধান , ভুট্টা বা সব্জির দাম কম পাচ্ছেন কৃষকরা।

তবু তাঁরা মোদির কথা মেনে খেত থেকে সুপার মারকেট চেইনের মালিক বড় কোম্পানীদের হাতে কৃষি ও কৃষকের ভবিষ্যৎ তুলে দিতে রাজি নন। ওদের বক্তব্য: পঞ্জাব-হরিয়ানার বড় চাষীরা যখন আম্বানি-আদানিদের কাছে নিজেদের জমিতে পছন্দসই ফসল চাষ ও দাম নিয়ে দর- কষাকষি করার অধিকার এবং আখেরে জমিরউপর অধিকার হারানোর আশঙ্কায়, তখন বাংলার ছোট চাষী রা কি করে এই নয়া আইনগুলি মেনে নেবে? ইতিমধ্যে আলু , পেঁয়াজ, সর্ষের তেল ইত্যাদি নিয়ে মজুতদারী বিরোধী অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের নিশেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কুফল ফলছে। আলু-পেঁয়াজ-তেলের আগুনদরের ঠেলায় মধ্যবিত্তর চোখে সর্ষে ফুল।

এইসব ভাবনা থেকেই সমাবেশ মঞ্চ থেকে কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনকে জন আন্দোলনে পরিণত করার আহ্বান জানালেন কৃষক নেতারা। জানালেন, রাজ্যের গ্রামে গ্রামে এনিয়ে প্রচার চলবে।

এদিনের সমাবেশের আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য রাজভবনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবিপত্র পেশ করা হলেও রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় যথারীতি তা গ্রহণ করেননি। সাংবিধানিক রীতিনীতি রক্ষার বকলমে রাজ্য রাজনীতিতে তিনি বিজেপির পক্ষে অভূতপূর্বভাবে সক্রিয় হলেও কেন্দ্রবিরোধী দল ও সংগঠনগুলির বক্তব্য শোনা বা স্মারকলিপি গ্রহণে দায়িত্ব পালনে তার আগ্রহ দেখা যায় না। এদিনও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি।

spot_img

Related articles

Politics, Power, and Cinema: Author Rasheed Kidwai Captivates Dubai Audience

Dubai: Literature enthusiasts from India and Dubai gathered at the India Club for a memorable evening with celebrated...

The Untamed Soul of Indian Cinema: How Ritwik Ghatak’s Art Still Speaks to Our Times

The World Cinema Project has restored, among other films, Titas Ekti Nodir Naam by Ritwik Ghatak. Martin Scorsese,...

How India’s Symbol of Love Is Being Twisted into a Tool of Hate

The Taj Mahal, regarded as one of the Seven Wonders of the World, is one of the major...

“Students Don’t Know Who Fazlul Huq Was”: Bengal Scholars Lament Erasure of Sher-e-Bangla’s Legacy

Kolkata: “In many colleges and universities, students and even teachers are unaware of who Fazlul Huq truly was,”...