eNewsroom India Logo

‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ “থেকে শুরু করে বিভাজক রাজনীতি: একজন মুসলিম নারীর দৃষ্টিভঙ্গি

Date:

Share post:

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
না, আমি অনুপ্রবেশকারী নই। এবং এটাও পরিষ্কার করে জানিয়ে রাখা ভালো আমার পরিবারের কেউ অনুপ্রবেশকারী নয়। বরং যাঁকে আপনি, মানে আপনার সরকার এই বছর ভারতরত্ন দিল, সেই বাবরি মসজিদ ভাঙায় নেতৃত্ব দেওয়া লালকৃষ্ণ আডবানি ভারতে এসে নাগরিকত্ব নেওয়ার আগে থেকেই আমার পূর্বপুরুষরা এদেশে বাস করতেন। এবং আপনার ও আপনার পরামর্শদাতাদের জেনে রাখা ভালো, আমার পূর্বপুরুষরা মুঘলদের অনেক আগে এদেশে এসে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু ভারতবর্ষের একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে আমি প্রতিদিন বিস্মিত হচ্ছি, প্রতিদিন আপনি আপনার জনসভা থেকে কীভাবে আমাদের, ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি এইরকম ‘বিদ্বেষমূলক’ ভাষণ দিচ্ছেন? যদি আমি ধরেও নিই, আপনি এবং আপনার দল ভারতবর্ষকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ঘোষণা করতে চান, এবং আমাদের ‘দ্বিতীয়’ শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখতে চান, তাহলেও কি কোনও দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের প্রতি এইরকম ঘৃণা ভরা শব্দ উচ্চারণ করা যায়? আপনি, হ্যাঁ, আপনি যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, দেশের শীর্ষপদে থেকে আমাদের, মানে মুসলিমদের প্রতি এইরকম ঘৃণাভাষণ দেন, তাহলে আপনার দলের নীচুতলার কর্মীরা বা বিজেপি সমর্থকরা ঠিক কী আচরণ করবে? আপনার বক্তব্য কি আসলে সাধারণ মানুষকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে না? এরপরে কি গণপিটুনি বা কারো ফ্রিজে গো-মাংস লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই সন্দেহে বাড়িতে ঢুকে মুসলিমদের পিটিয়ে মারার ঘটনা বাড়বে না?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের কিছু প্রতিবেশী দেশে এবং ইউরোপ-আমেরিকাতেও কাজ করার সূত্রে আমি আপনার বক্তৃতা শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছি! এরপরে আর কোনও প্রতিবেশী মুসলিম দেশের ছাত্র-ছাত্রীকে আপনি ভারত সরকারের স্কলারশিপ দিয়ে ভারতে পড়তে ডেকে আনতে উৎসাহ দিতে পারবেন তো? এমনিতেই প্রতিবেশী দেশে গেলে আমাদের শুনতে হয়, আজকাল তো তোমাদের ভারতবর্ষে মুসলিম ভেবে পিটিয়ে মারা হয়, হিজাব পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে তাড়া করা হয়, আপনার মুসলিমদের নিশানা করার পরে কোনও প্রতিবেশী দেশে গিয়ে আমরা ভারতীয় হিসেবে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারব? ইউরোপ-আমেরিকায় শুনেছি, তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, ‘তোমাদের ওখানে তো গো-মাংস খেলে পিটিয়ে মারা হয়?’ আপনি এবং আপনার মন্ত্রিসভার সহকর্মীরা যেভাবে শুধু আমিষ খাওয়ার কারণে মানুষকে নিশানা করেছেন, এরপরে কী জবাব দেব একজন ভারতীয় হিসেবে?

মাননীয় নরেন্দ্র মোদি, আপনি যখন ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’-এর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আমি বিশ্বাস করেছিলাম। আপনি বা আপনার দলের সমর্থকরা যখন ‘জয় শ্রীরাম’ বলেন, তখন আমিও ভগবান রামের প্রতি প্রণাম জানাই। আমিও শ্রীকৃষ্ণ বা শিবের প্রতি নিয়ত শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু তাই বলে আপনার দলের সমর্থকরা একজন মুসলিম যুবককে শুধুমাত্র ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান না দেওয়ার ‘অপরাধ’-এ পিটিয়ে মারবে, এটাকে কী করে সমর্থন করি? প্রতিবেশী কোনও মুসলিম দেশে কোনও অমুসলিম যদি ‘আল্লাহ্ হো আকবর’ বলতে রাজি না হয়, তাহলে তাকে হত্যা করা যতটা অপরাধ, ভারতবর্ষে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তাও ততটাই ‘অপরাধ’। এবং দুর্ভাগ্যের বিষয়, দেশের শীর্ষপদ থেকে সেই ঘৃণা বা বিদ্বেষে প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে আমাদের, মানে মুসলিমদের নিশানা করছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের প্রাকৃতিক সম্পদ বন্টনের বিষয়টির ভুল ব্যাখ্যা করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন চাইছেন, ঠিক সেই সময় দেশেরই বিভিন্ন সিনেমা হলে ‘ময়দান’ নামে একটি সিনেমা চলছে। সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ফুটবল মাঠে এগারো জন ভারতীয়ের জয়গাথা রচনার অসামান্য উপাখ্যান। সেই ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে কেউ শিখ ছিলেন, কেউ মুসলিম, কেউ হিন্দু। আর হ্যাঁ, ওই এগারো জন ভারতীয় ফুটবলারের কোচ ছিলেন একজন হায়দ্রাবাদি মুসলমান, দেশের মানুষ যাঁকে আজও ‘রহিম সাহেব’ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে। এটা আলাদা কথা রহিম সাহেব যখন এগারো জন ভারতীয় ফুটবলারকে নিয়ে এই চমকপ্রদ সাফল্য পেয়েছিলেন, তখন ভারতবর্ষের অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এবং সেই প্রধানমন্ত্রী দলিতদের এই ‘মিথ্যে কথা’ বলে ক্ষ্যাপানো চেষ্টা করেননি যে, তাদের সব সম্পদ আমাদের মানে মুসলিমদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে কোনও রাজনৈতিক দল।

মাননীয় নরেন্দ্র মোদি, আপনি যখন মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী আর আমিষ খাওয়ার জন্য কাঠগড়ায় তোলেন, তখন বিশ্বকাপ ফাইনালের পরে ড্রেসিং রুমে গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের পেসার মহম্মদ শামিকে আপনার জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটার কথা ভাবি! ভাবি, কোনটা সত্যি? ভাবি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ১৪০ কোটি মানুষের দেশের প্রধানমন্ত্রী আসলে কোন বার্তাটা দিতে চাইছেন? একদিকে আপনি এবং আপনার দলের ছোট-বড়-মেজো নেতারা নিত্যদিন মুঘলদের গালি দেবেন, আবার কোনও বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক এলে তাঁর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে তাজমহলের সামনে ছবি তুলবেন, এর চাইতে বড় দ্বিচারিতা আর কী হতে পারে? হয় আপনার ভক্তদের বলুন তাজমহলকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে, তা না হলে শুধু সিলেবাস থকে মুঘলদের পর্ব বাদ দিয়ে আপনি, বা আপনার পরামর্শদাতারা ইতিহাসকে বদলে দিতে পারবেন না।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, দেশে ভোটে জিততে গিয়ে ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য আপনি এবং আপনার দলের সমর্থকরা যা বলেন, আসলে তার সঙ্গে আপনাদের কাজকর্মের, বা বলা চলে, বাস্তবের কোনও মিল নেই। এই যেমন আপনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, বাঙালি হয়েও বাঙালিকে গাল পেড়ে দিল্লিতে বাংলো বা নীলবাতিওয়ালা গাড়ি পেতে উৎসুক সঞ্জীব সান্যাল যখন মৃণাল সেনের সিনেমা নিয়ে বাঙালিকে ‘নৈরাশ্যবাদী’ আখ্যা দেন, তখন ভুলে যান কলকাতার সেই বামপন্থী পরিচালক ‘মৃগয়া’ না বানালে বিজেপি তার ‘তারকা প্রচারক’ মিঠুন চক্রবর্তীকে কোনওদিন পেতই না!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আজকাল বিভিন্ন বক্তৃতায় আপনি আপনার রাজনৈতিক বিরোধীদের মুসলিম লীগের সঙ্গে তুলনা করেন। একজন মুসলমান হিসেবে আমি আপনাকে বিনীতভাবে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সুভাষচন্দ্র বোসের সঙ্গে মহম্মদ আলি জিন্নার যে চিঠিপত্র চালাচালি হয়েছিল, তা আরেকবার দেখে নিতে অনুরোধ করব। আপনি নেহরুকে খাটো করতে গিয়ে যে নেতাজিকে মাঝেমাঝেই অবলম্বন করেন, সেই সুভাষ বোস কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে চিঠি লিখে জিন্নাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, মুসলিম লীগ ভারতবর্ষের সব মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে না। আপনি হয়তো জানেন না, সেদিন জিন্না রোজ বলতেন কংগ্রেস হিন্দুদের দল। নেতাজি বলেছিলেন, কংগ্রেস হিন্দু-মুসলিম, সবার দল। আপনি যখন মুসলিম লীগ বলে ধর্মীয় মেরুকরণ করে শুধুমাত্র ভোটে জিতে খুশি থাকতে চান, তখন আপনাকে বিনীতভাবে বলি, ভারতের সব মুসলমান কোনওদিন মুসলিম লীগের সমর্থকও ছিল না, দেশভাগও চায়নি। যেমন আমার দাদু, সৈয়দ সিরাজ আলি, যিনি দিল্লির জামা মসজিদে দাঁড়িয়ে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের বক্তৃতা শুনে ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি রাষ্ট্র পাকিস্তানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ, নেহরু থেকে আজাদ, সুভাষ বোস থেকে মহাত্মা গান্ধী সবাই ভারতবর্ষকে ‘সবার ভারত’ করে তুলতে চেয়েছিলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আজ সেই ভারতবর্ষকে বদলে দিতে পারেন। বিদেশের চোখে গান্ধীর ভারতবর্ষকে, যে গান্ধীকে অনুসরণ করতেন মার্টিন লুথার কিং, কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, সেই গান্ধীর ভারতবর্ষকে বদলে দিয়ে আপনি মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকেও পরিবর্তিত করে দিতে পারেন। আমাদের জন্য ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-ও অপেক্ষায় থাকতে পারে, কিন্তু কোনও মিথ্যাভাষণই ইতিহাসকে বদলে দিতে পারবে না। শুধু ভবিষ্যতের ভারত এই দিনগুলোর জন্য লজ্জায় মাথা হেঁট করবে।

এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি অনুবাদ

spot_img

Related articles

Politics, Power, and Cinema: Author Rasheed Kidwai Captivates Dubai Audience

Dubai: Literature enthusiasts from India and Dubai gathered at the India Club for a memorable evening with celebrated...

The Untamed Soul of Indian Cinema: How Ritwik Ghatak’s Art Still Speaks to Our Times

The World Cinema Project has restored, among other films, Titas Ekti Nodir Naam by Ritwik Ghatak. Martin Scorsese,...

How India’s Symbol of Love Is Being Twisted into a Tool of Hate

The Taj Mahal, regarded as one of the Seven Wonders of the World, is one of the major...

“Students Don’t Know Who Fazlul Huq Was”: Bengal Scholars Lament Erasure of Sher-e-Bangla’s Legacy

Kolkata: “In many colleges and universities, students and even teachers are unaware of who Fazlul Huq truly was,”...