৬ ডিসেম্বর, আবেগ আর হিকমাহ: মুর্শিদাবাদের নতুন মসজিদকে ঘিরে বড় প্রশ্ন

মুর্শিদাবাদের নতুন মসজিদ ঘোষণার আবেগ গভীর হলেও কুরআন আমাদের সতর্ক করে দেয় মসজিদে দিরারের ঘটনায়। সূরা তওবা ৯:১০৮-এ আল্লাহ বলেন—“আপনি সেখানে কখনোই দাঁড়াবেন না”—যে স্থাপনা বিভেদ ও ফিতনার উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে। তাই নিয়ত, উদ্দেশ্য এবং সময়—সবকিছুই আজ গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে

Date:

Share post:

৬ ডিসেম্বর এমন একটি দিন যা প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে গভীরভাবে খোদাই হয়ে আছে, বিশেষ করে ভারতের মুসলমানদের হৃদয়ে।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ভাঙন শুধু একটি স্থাপনার পতন ছিল না; এটি এমন এক ক্ষত, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে চলেছে। আজও সেই ব্যথা মুছে যায়নি — হয়তো কোনোদিনই যাবে না। কিছু ক্ষত থেকেই যায়, কারণ সেগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা কারা, কী হারিয়েছি, এবং কী রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।

এই আবেগঘন প্রেক্ষাপটে নতুন একটি মসজিদের সংবাদ আশা এবং আত্মপর্যালোচনা—দুটোই আনে। মসজিদ তো আমাদের দ্বীনের অন্যতম বড় প্রতীক। আল্লাহ বলেন:

“আল্লাহর মসজিদ নির্মাণ করে তারা-ই, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে…” (সূরা তওবা ৯:১৮)

আর রাসুল ﷺ বলেছেন:

“যে কেউ আল্লাহর জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করেন।” (বুখারি ও মুসলিম)

এটি এমন একটি আমল, যার ফজিলত খুব অল্প আমলের সঙ্গেই তুলনীয়।

কিন্তু আমাদের আলেমরা সবসময় একটি বিষয় জোর দিয়ে বলেছেন—এই বিপুল সওয়াব শুধু ভবনের কারণে নয়; এর পেছনের নিয়তের কারণে।

একটি মসজিদ যদি তাকওয়া, হালাল অর্থ ও খাঁটি নিয়তে তৈরি হয়, তবে সেটি পৃথিবীতে নূর হয়ে দাঁড়ায়।
আর যদি তা প্রদর্শন, রাজনীতি বা বিভেদের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়—তাহলে তার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যায়।

মুর্শিদাবাদে নতুন মসজিদ

৬ ডিসেম্বর ২০২৫ সালে মুর্শিদাবাদে একটি নতুন মসজিদ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। মানুষ ইট ও অর্থ নিয়ে আসে; আবেগ ও উত্তেজনা স্পষ্ট ছিল। বাবরি মসজিদের স্মৃতি স্বাভাবিকভাবেই এই অনুভূতিকে আরও গভীর করেছে।

ন্যায় ও সুবিচারের জন্য একটি কথা স্পষ্ট: নিয়ত কেবল আল্লাহই জানেন।

আমরা কারও—এমনকি কোনো রাজনীতিবিদেরও—হৃদয়ের ভিতর কী আছে তা দাবি করতে পারি না।
হতে পারে, এমএলএ-র নিয়ত সম্পূর্ণ আন্তরিক এবং ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থমুক্ত।

কিন্তু নিয়ত গোপন হলেও পরিস্থিতি প্রকাশ্য—আর পরিস্থিতির গুরুত্ব অনেক।

এবং আজকের বাংলার পরিস্থিতি সংবেদনশীল।

রাজনৈতিক উত্তেজনা আছে, সাম্প্রদায়িক উদ্বেগ রয়েছে, এবং নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। এই পরিবেশে—even a well-intended step—অর্থাৎ ভালো নিয়তের কাজও—অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, কখনও কখনও ক্ষতিকর ফলও দিতে পারে।

মসজিদের প্রস্তাবিত নাম, ঘোষণার সময়, জনসমাবেশ—সবই চিন্তাভাবনার দাবি রাখে।
আবেগ এক জিনিস, কিন্তু হিকমাহ (বিকল্পহীন প্রজ্ঞা) অপরিহার্য।

যখন এমএলএ বাবরি মসজিদ তৈরির ঘোষণা দেওয়ার কারণে দল থেকে বরখাস্ত হলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলেন।
এটা কী ইঙ্গিত করে?

ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়

যখনই মুসলমানরা প্রজ্ঞা, ঐক্য এবং আন্তরিকতার সাথে কাজ করেছে, আল্লাহ তাদের সম্মান ও শক্তি দিয়েছেন।
আর যখন আবেগ চিন্তাকে ছাড়িয়ে গেছে বা নিয়ত বিশুদ্ধ ছিল না—ফল হয়েছে কষ্টকর।

এগুলো দোষারোপের জন্য নয়; ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা।

কুরআন মসজিদে দিরারের মাধ্যমে আমাদের সতর্ক করে, যেখানে একটি “মসজিদ” নামের স্থাপনা আল্লাহর কাছে নিন্দিত হয়েছিল—কারণ সেটি তৈরি হয়েছিল ক্ষতি, বিভেদ এবং ফিতনার উদ্দেশ্যে।
আল্লাহ সেখানে বলেছেন:

“আপনি কখনোই সেখানে দাঁড়াবেন না (সালাতের জন্য)।” (সূরা তওবা ৯:১০৮)

এর মানে এই নয় যে প্রতিটি নতুন মসজিদ এই কাহিনীর মতো।
বরং এটি একটি চিরন্তন নীতি শেখায়:

একটি মসজিদের মূল্য তার গম্বুজ বা দেয়ালে নয়; বরং তার উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতায়।

এ নীতি সর্বত্র, সব সময় প্রযোজ্য।

একটি আন্তরিক আহ্বান

যদি এই নতুন মসজিদ তৈরি হয়, এবং যদি মানুষ তা সত্যিই চায়—তবে তা হোক তাকওয়ার উপর ভিত্তি করে, হালাল উপার্জনে, খাঁটি নিয়তে, এবং বিজ্ঞ নেতৃত্বে; যাতে তা রহমতের স্থান হয়।

একটি মসজিদের মহত্ত্ব ভিত্তিপ্রস্তরের আবেগে নয়—বরং যে তাকওয়া সেটিকে টিকিয়ে রাখে, তাতে।

আমরা মুসলমানদের হৃদয় সংবেদনশীল—বিশেষ করে ৬ ডিসেম্বরের মতো দিনে।
কিন্তু ঠিক এই দিনগুলোতেই প্রজ্ঞা সবচেয়ে বেশি দরকার।

কোনো মসজিদ প্রতিক্রিয়া হিসেবে, প্রতীকি অস্ত্র হিসেবে, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে, বা প্রতিশোধের বার্তা হিসেবে তৈরি হওয়া উচিত নয়।
মসজিদ শুধু আল্লাহর জন্য—এবং আল্লাহর জন্যই।

চলো আমরা এগোই সতর্কতার সঙ্গে, দুআ নিয়ে, পরামর্শ নিয়ে, এবং গভীর দায়িত্ববোধ নিয়ে।
কারণ অতীতের ক্ষত আমাদের ভবিষ্যতে ভুলের দিকে ঠেলে দেওয়া উচিত নয়।

আল্লাহ আমাদের সম্প্রদায়কে হিদায়াহ দিন, আমাদের নিয়ত শুদ্ধ করুন, এবং তাঁর নামে নির্মিত প্রতিটি মসজিদকে সুরক্ষিত রাখুন

আামীন।

 

এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত একটি মতামতের অনুবাদ

Faiz Anwar
Faiz Anwar
A Chartered Accountant by profession, he is passionate about social work and writes on issues that strengthen the social fabric
spot_img

Related articles

The Cost of Piety: Murshidabad’s Quran Recital and the Question of Intention

A planned mass Quran recitation in Murshidabad, expected to draw nearly one lakh participants, has triggered debate over its underlying niyyat. Supporters frame it as devotion, while critics question the timing, intention, and scale. The event’s purpose, more than its size, has become the real flashpoint.

New Masjid in Murshidabad: Qur’anic Caution for a Community Still Healing from Babri

A new mosque project in Murshidabad has triggered discussion over intention and politics, especially on December 6. Qur’an 9:108 and the Masjid Dhirar lesson stress sincerity as the foundation of any masjid. With Babri’s memory alive, the community urges caution and taqwa.

Delhi Teen Saahil Shot at Close Range by CISF Constable: A Brutal Reminder of India’s Unchecked Uniformed Power

Saahil, 14, was collecting stray wedding notes in Delhi when a drunk CISF constable slapped him and shot him point-blank. His death reveals deep structural failures—unchecked police power, weak firearm regulations, child labour, and social inequality that make poor children India’s most vulnerable targets of State violence.

How the Babri Masjid Demolition Became a Turning Point in India’s Constitutional Decline

Thirty-three years after the demolition of the Babri Masjid, the event occupies a troubled and unresolved position in...