আরও একটা ব্যর্থ রিমেক প্রসঙ্গে বাংলা ছবি নিয়ে কিছু কথা

Date:

Share post:

[dropcap]স[/dropcap]ন্দীপ রায়, সাংবাদিক রশ্মিলা ভট্টাচার্য আর আমি রায়বাড়িতে বসে বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমি ওঁদের বললাম যে সুমন ঘোষের কাবুলিওয়ালা দেখে আমি মোটেই সন্তুষ্ট হইনি, কারণ তপন সিংহ আর হেমেন গুপ্ত ওই গল্প নিয়ে যথাক্রমে বাংলা আর হিন্দিতে যে ছবি দুটো করেছিলেন এটা তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। সন্দীপ কখনো কারোর কড়া সমালোচনা করেন না। তিনি কেবল মৃদু হেসে বললেন “কোনো ক্লাসিক নিয়ে একবার কাজ হয়ে যাওয়ার পরে আর রিমেক করা উচিত নয়।”

আমার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, আমি মিঠুন চক্রবর্তীকে রবীন্দ্রনাথের অমর গল্পটার কাবুলিওয়ালা হিসাবে একেবারেই হজম করতে পারিনি। তপন সিংহের ছবিতে ছবি বিশ্বাস নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এবং জীবনের অন্যতম সেরা কাজ করেছিলেন। পণ্ডিত রবিশঙ্করের অসামান্য আবহসঙ্গীতে আফগানিস্তানের প্রতিধ্বনি ছিল। সেই ছবি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে একটা পুরস্কারও জিতেছিল। কিংবদন্তি অভিনেতা ছবির শিশুশিল্পী টিঙ্কু ঠাকুরের (মিনি) সঙ্গে যে দৃশ্যগুলো ছিল, সেগুলো রীতিমত অভিনয়ের পাঠ বলা যায়। সত্যজিৎ রায় বলেছেন, ছবি বা বলরাজ সাহনির মত করে আর কোনো অভিনেতা কাবুলিওয়ালাকে অমর করে দিতে পারতেন না।

বিমল রায় প্রযোজিত হিন্দি ছবিটায় তাঁর নিজের নির্দেশনার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা হেমেন অনুসরণ করেছিলেন। অশোককুমার একবার আমাকে বলেছিলেন যে বলরাজকে তিনি শ্রদ্ধা করেন কারণ ওই একটা চরিত্রের জন্যে তিনি কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে মেলামেশা করেছিলেন এবং মনোযোগ দিয়ে তাদের জীবনযাত্রা লক্ষ করেছিলেন। ছবিতে মিনির সেরে ওঠার জন্যে বলরাজের প্রার্থনার দৃশ্য অতুলনীয়। তপন সিংহ তো বলেছিলেন বলরাজের অভিনয় নাকি ছবি বিশ্বাসের চেয়েও ভাল হয়েছিল। সলিল চৌধুরীর মনে থেকে যাওয়ার মত সুরে ‘অ্যায় মেরে পেয়ারে ওয়াতন’ আর ‘গঙ্গা আয়ে কহাঁ সে’ ছবির সঙ্গীতকেও অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।

সুমন ঘোষের ছবিতে কাবুলিওয়ালার চরিত্রে মিঠুনকে কিন্তু একেবারেই মানায়নি। মিঠুন মৃণাল সেনের আবিষ্কার হলেও ছবি বিশ্বাস বা বলরাজের মত অভিনয় ক্ষমতা তাঁর নেই। মিঠুনের ক্ষমতা সীমিত। নির্দেশক সুমন কাবুলিওয়ালা রিমেক করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদী সাহিত্যের যে মর্মবস্তু তা তাঁর ছবিতে আদৌ ধরা পড়েনি। মৃণাল সেন যে বলেছিলেন বাংলা ছবির আধুনিক নির্দেশকদের চিত্রনাট্য তৈরির ক্ষমতা নেই, সেটা যে একেবারেই ভুল নয় তা বোঝা যায়।

এদিক থেকে অপর্ণা সেন অবশ্যই সৃজিত মুখার্জি বা সুমন ঘোষের চেয়ে উন্নত। তবে থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেন আর মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার বাদে অপর্ণার অন্য ছবিগুলো কিন্তু অজয় কর, অসিত সেন, বিজয় বোসদের ছবির মত কালজয়ী হয়ে উঠতে পারেনি। এই নির্দেশকরা বাণিজ্যিক ছবি বা বাণিজ্যিক ছবি আর আর্ট ফিল্মের মাঝের পথ ধরেছিলেন, অথচ রসসমৃদ্ধ চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। সাত পাকে বাঁধাদীপ জ্বেলে যাই আর আরোগ্য নিকেতন দেখলেই তা স্পষ্ট হয়।

বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান নির্দেশক কৌশিক গাঙ্গুলি খারিজ ছবির সিকুয়েল হিসাবে সম্প্রতি পালান নামে একটি ছবি করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে “মূলধারার বাংলা ছবির ধারণায় বিরাট পরিবর্তন এসেছে।” পালান কিন্তু খারিজের সঙ্গে কোনো আলোচনাতেই আসতে পারবে না। গৌতম ঘোষ বললেন “আমার আবার অরণ্যে ছিল অরণ্যের দিনরাত্রি-র এক ধরনের সম্প্রসারণ। ওটা লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নির্দেশক সত্যজিতের প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।” তিনি স্বীকার করলেন যে তাঁর ছবি সত্যজিতের ছবির ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি এবং ক্লাসিকগুলোর রিমেক না করাই উচিত।

রশ্মিলা উল্লেখ করেছিলেন যে সৃজিতের শাহজাহান রিজেন্সি-রও ১৯৬৮ সালের চৌরঙ্গি  ছবিটার সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না। আমি একমত হলাম, কারণ আমিও ছবিটা দেখে অত্যন্ত হতাশ হয়েছিলাম এবং মমতাশংকরকে বলেছিলাম যে ওই ছবিতে তাঁর অভিনয় কতটা বিস্মরণযোগ্য। উনি জবাবে কিছু বলতে পারেননি। আমি নিশ্চিত যে কথাটা ওঁর পছন্দ হয়নি।

আসলে আজকের বাংলা সিনেমা ছবি তৈরির সমস্ত ক্ষেত্রে প্রতিভার ভীষণ অভাবে ধুঁকছে। মুক্তি পাওয়া বেশিরভাগ ছবি দ্রুত সকলে ভুলে যায়। আজকের ছবি নির্মাতাদের কঠোরভাবে কনটেন্ট, সিনেম্যাটিক ন্যারেটিভি এবং মৌলিকত্বের উপর মনোযোগ দেওয়া দরকার। মনে পড়ে, সত্যজিৎ তিন দশকেরও বেশি আগে আমাকে বলেছিলেন যে ভবিষ্যতে বাংলা ছবিতে সৃজনশীলতার প্রবল সংকট দেখা দেবে। তাঁর কথা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।

স্টিভেন স্পিলবার্গ যদি ডায়রি অফ অ্যান ফ্র্যাঙ্ক নিয়ে ছবি করার লোভ সামলাতে পারেন, তাহলে লম্বা চওড়া কথা বলা মধ্যমেধার বাঙালি নির্দেশকরা কেন পারবেন না? সিনেমাবেত্তা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বললেন “অতীতের স্মরণীয় ছবি আবার তৈরি না করে আজকের প্রজন্মের নির্দেশকদের নতুন, সমসাময়িক বিষয়ে মন দেওয়া উচিত, যার আবেদন দর্শকের বুদ্ধিবৃত্তি আর হৃদয়, দুটোর কাছেই।”

 

spot_img

Related articles

Garlands for Accused, Silence for Victim: Gita Path Assault Survivor Gets No Support

Eight days after a mob attack during Kolkata’s Gita Path event, patty seller Sheikh Riyajul remains traumatised and jobless. His Rs 3,000 earnings were destroyed, and the five accused walked free on bail. With no help from authorities or society, fear and financial pressure may force him to return.

Vande Mataram and the Crisis of Inclusive Nationalism: A Minority Perspective India Can’t Ignore

As India marks 150 years of Vande Mataram, political celebration has reignited long-standing objections from Muslims and other minorities. The debate highlights tensions between religious conscience, historical memory, and the risk of imposing majoritarian symbols as tests of national loyalty.

Bengal SIR Exercise Reveals Surprising Patterns in Voter Deletions

ECI draft electoral rolls show 58 lakh voter deletions in West Bengal. Data and independent analysis suggest non-Muslims, particularly Matuas and non-Bengali voters, are more affected. The findings challenge claims that voter exclusions under the SIR exercise primarily target Muslim infiltrators.

A Veil Pulled, a Constitution Crossed: The Nitish Kumar Hijab Controversy

A video showing Bihar Chief Minister Nitish Kumar pulling Dr Nusrat Parveen’s veil during an official event has sparked constitutional concern. Critics say the act violated bodily autonomy, dignity, and Article 21, raising questions about state restraint, consent, and the limits of executive power in a democracy.