গান যখন ঘৃণার ভগীরথ: হিন্দুত্ববাদের নতুন অস্ত্র

Date:

Share post:

[dropcap]শে[/dropcap]ক্সপীয়রের নাটক টুয়েলফথ নাইট-এ একটি সংলাপ ছিল “সুর যদি ভালবাসার রসদ যোগায়, তবে বাজাতে থাকো, বাজাতে থাকো, বাজাতেই থাকো।” কিন্তু ভালবাসার বদলে যদি এতে বসিয়ে দেওয়া হয় ঘৃণা?

ঘৃণার খোরাক জোগায় যে গান, সে গানেরও তালে তালে মাথা দোলাবার উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন ভারতের জনতাকে, ধীরে ধীরে। কিন্তু বিরামহীনভাবে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা যাঁদের এখনো বিব্রত করে, তাঁরা সভয়ে দেখছেন এই বর্বরতা।

জন্ম দেওয়া হচ্ছে এক নতুন সংস্কৃতির, যেখানে গান-কবিতা-বইয়ের মত উপাদানগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যেকার বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে দিতে। মিছিলে বা জমায়েতে এইসব সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক গান, কবিতা, বা বইয়ের পাঠ হিংসা ছড়াচ্ছে, ঘনিয়ে তুলছে দাঙ্গা পরিস্থিতি।

কিন্তু এই বিষাক্ত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উপায় কি আমাদের হাতে আছে?

এই প্রশ্নটিই সম্প্রতি উঠে এল কলকাতায় বিশিষ্ট সমাজকর্মী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সায়রা শাহ হালিমের বাড়িতে আয়োজিত ঘন্টা দুয়েকের একটি আলোচনাসভায়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক কুণাল পুরোহিত।

হিন্দুত্ববাদী পপ সংস্কৃতি ভারতীয় মুসলমানরা বই ঘৃণা করে
লেখক কুণাল পুরোহিতের সঙ্গে সায়রা শাহ হালিম

তাঁর সাম্প্রতিক বই এইচ-পপ… দ্য সিক্রেটিভ ওয়ার্ল্ড অফ হিন্দুত্ব পপ স্টারস সম্পর্কে বলতে গিয়ে কুণাল ব্যাখ্যা করলেন, কীভাবে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন গান, কবিতা, বই বা পুস্তিকা সাম্প্রদায়িক ঘৃণাকে সার জল দিয়ে চলেছে। কিছু ভিডিও এবং গানের নমুনা তিনি তুলে ধরেন শ্রোতাদের সামনে, যেগুলো প্রায়ই ঘৃণা ছড়াতে বা উত্তেজনা বাড়াতে ব্যবহার করা হয়। রামনবমীর শোভাযাত্রায় এগুলির ব্যাপক ব্যবহার হয়। বিশেষ করে মুসলমান মহল্লা অথবা মসজিদের কাছ দিয়ে শোভাযাত্রা যাওয়ার সময়ে এইসব গান বাজতে শোনা যায়।

উদাহরণ হিসাবে কুণাল বলেন “আমি যখন এই জাতীয় বিদ্বেষজনিত অপরাধের বিষয়ে খবর করতাম, তখনই ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলায় এক মুসলমান কিশোরকে পিটিয়ে মারার খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু যা প্রকাশ পায়নি তা হল, যে ছেলেগুলি মহম্মদ সালিক নামের ওই কিশোরকে হত্যা করেছিল, তারা রামনবমীর মিছিলে এইরকম প্ররোচনামূলক গানের সঙ্গে নাচতে নাচতে যাচ্ছিল। মসজিদের কাছে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ স্থানীয় প্রথামাফিক রামনবমীর মিছিলটিকে স্বাগত জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু মসজিদের কাছাকাছি আসতেই মিছিলের জনতা বেলাগাম হয়ে ওঠে।”

তাঁর মতে, সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক গদ্য-পদ্য-গান হিন্দি বলয়ে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ক্রমশ অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রসঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে যে কলকাতার বিভিন্ন স্কুলেও এখন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেকার কথাবার্তায় কীভাবে ফুটে উঠছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক মনোভাব। ধর্মীয় পরিচয়ে সহপাঠীদের চিহ্নিত করে ফেলছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। সোশাল মিডিয়ায় একাধিক ঘটনার কথা জানা যাচ্ছে যেখানে শিক্ষক-শিক্ষিকারা মুসলমান ছাত্রদের তিরস্কারের সময়ে বলছেন “এরকম কি তোমাকে মসজিদ থেকে শিখিয়েছে?”

এই নয়া সাংস্কৃতিক প্রবণতার মোকাবিলায় নাগরিক সমাজের দায়িত্বের বিষয়টিতে জোর দিয়ে কুণাল বলেন “কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে চাইলেও এ ব্যাপারে খুব কিছু করা সম্ভব না। কারণ যে মুহূর্তে তারা এগুলি নিয়ে বলবে, তাদের হিন্দুবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে। এই হিন্দুত্ব পপ কালচারের বিরুদ্ধে ব্যক্তি হিসাবেই আমাদের যতটুকু যা করণীয় করতে হবে।”

সায়রার বাবা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জমীরউদ্দিন শাহ এ প্রসঙ্গে দ্বিমুখী প্রচেষ্টার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তাঁর মতে “অমুসলমান নাগরিকদের এই বিদ্বেষমূলক আলেখ্যগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। কারণ তাঁদের কথা অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব দিয়ে শোনা হবে। অন্যদিকে মুসলমানদের লক্ষ্য হবে তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতদূর সম্ভব সাফল্য অর্জন করা। মহম্মদ শামিকে দেখুন। তাঁর ক্রিকেটে সাফল্যের কারণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁকে আলিঙ্গন করছেন। দেশের সাফল্যে অবদান রাখতে পারলে তা মুসলমানদের সম্বন্ধে দেশের মানুষের মনোভাব বদলাতে সাহায্য করবে।”

আলোচনায় উপস্থিত শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা ইতিহাসের পাঠক্রম পরিবর্তন নিয়ে তাঁদের অসহায়তার কথা ব্যক্ত করেন। জনৈক অভিভাবকের ভাষায় “মোগল যুগের ইতিহাস বাদ দেওয়ার মাধ্যমে আমরা যা করছি তা হল ভারতের বর্ণময় অতীত সম্বন্ধে সীমিত জ্ঞানসম্পন্ন একটি প্রজন্ম তৈরি করা।”

হিন্দুত্ব আলেখ্যের বিপরীতধর্মী আলেখ্য তৈরি করার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা তুলে ধরে উপস্থিত চলচ্চিত্র নির্মাতা অশোক বিশ্বনাথন বলেন “আমাদের বুঝতে হবে যে এই ধরনের সংস্কৃতির প্রসার ভারতে নব্য-নাজি উত্থানের সমতুল। ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ঘুম থেকে তুলতে হবে। তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে তারা কোনো প্রতিরোধমূলক অবস্থান না নেওয়ার জন্যই ভারত ক্রমশ নাজি পথে এগিয়ে চলেছে এবং এটা মেনে নেওয়া চলবে না।”

 

এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি অনুবাদ

spot_img

Related articles

Garlands for Accused, Silence for Victim: Gita Path Assault Survivor Gets No Support

Eight days after a mob attack during Kolkata’s Gita Path event, patty seller Sheikh Riyajul remains traumatised and jobless. His Rs 3,000 earnings were destroyed, and the five accused walked free on bail. With no help from authorities or society, fear and financial pressure may force him to return.

Vande Mataram and the Crisis of Inclusive Nationalism: A Minority Perspective India Can’t Ignore

As India marks 150 years of Vande Mataram, political celebration has reignited long-standing objections from Muslims and other minorities. The debate highlights tensions between religious conscience, historical memory, and the risk of imposing majoritarian symbols as tests of national loyalty.

Bengal SIR Exercise Reveals Surprising Patterns in Voter Deletions

ECI draft electoral rolls show 58 lakh voter deletions in West Bengal. Data and independent analysis suggest non-Muslims, particularly Matuas and non-Bengali voters, are more affected. The findings challenge claims that voter exclusions under the SIR exercise primarily target Muslim infiltrators.

A Veil Pulled, a Constitution Crossed: The Nitish Kumar Hijab Controversy

A video showing Bihar Chief Minister Nitish Kumar pulling Dr Nusrat Parveen’s veil during an official event has sparked constitutional concern. Critics say the act violated bodily autonomy, dignity, and Article 21, raising questions about state restraint, consent, and the limits of executive power in a democracy.