সত্য, প্রেম এবং অহিংসা: হিন্দু ধর্মের রাহুল গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি

Date:

Share post:

সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সংসদ এমন এক জায়গা হয়ে উঠেছে যেখানে সত্যি সত্যি বিরোধী স্বরের পরিসর রয়েছে। রাষ্ট্রপতির ভাষণ নিয়ে বিতর্কের পর লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী জবাবি ভাষণে দেশের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেছেন। সেই ভাষণের একটি অংশ, যা কার্যবিবরণী থেকে সম্ভবত ইতিমধ্যেই মুছে ফেলা হয়েছে, ছিল হিন্দুধর্মের প্রকৃতি সম্পর্কে। রাহুলের মতে, হিন্দুধর্মের ভিত্তি হল সত্য ও অহিংসা। ‘ভারত অহিংসার দেশ, ভয়ের দেশ নয়। আমাদের সমস্ত মহাপুরুষ অহিংসার কথা এবং ভয়কে জয় করার কথা বলেছেন।’ একথা বলার পর বিজেপি সাংসদদের বেঞ্চের দিকে আঙুল তুলে রাহুল যোগ করেন ‘অথচ যারা নিজেদের হিন্দু বলে, তারা সারাদিন হিংসা, ঘৃণা আর অসত্য বলে বেড়ায়।’

তারপর থেকে বহু সাধু, সন্ন্যাসী রাহুলের বিবৃতির প্রতিবাদ করেছেন। আমেদাবাদের কংগ্রেস দফতরের উপর আক্রমণ চালানো হয়েছে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বলছে রাহুল হিন্দুদের সহিংস বলেছেন ইত্যাদি। অন্যদিকে রাহুল তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আরএসএসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিরা এই সুযোগে বলে বেড়াচ্ছেন যে জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে রাহুল পর্যন্ত কারোর আদর্শ দেশের বাস্তবতায় সম্পৃক্ত নয়। তাঁদের মতে নেহরু, রাহুল প্রমুখ কেবল সংখ্যালঘুদের নিয়ে কথা বলেন ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত রাখার জন্য।

হিন্দুধর্মের যে মানবতাবাদী ব্যাখ্যা রাহুল দিয়েছেন, ইন্ডিয়া ব্লকের অনেকেই তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এই মুহূর্তে হিন্দুধর্ম আর হিন্দুত্ব শব্দ দুটোর ব্যবহারে তফাত রাখা হচ্ছে না। যেমন উদ্ধব ঠাকরে বলেছেন হিন্দুত্ব সম্পর্কে তাঁর মতামত রাহুল যা বলেছেন (হিন্দুধর্ম সম্পর্কে) তার অনুরূপ। আরএসএস মতাদর্শে বিশ্বাসীরা নেহরুর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অভিযানের সমালোচনা করে সেটিকে আরএসএসের বিরুদ্ধে অভিযান হিসাবে চিহ্নিত করেন! তাঁরা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধন করার বিরোধিতা করার জন্যেও নেহরুর নিন্দা করেন। তাঁদের বক্তব্য, আরএসএসের হিন্দুত্ব দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির উত্তরাধিকার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আরএসএসের আদর্শের সঙ্গে দয়ানন্দ আর বিবেকানন্দের আদর্শের সম্পর্কে মোটেই খুব জোরালো নয়। ওই নামগুলো ব্যবহার করে আরএসএস শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত করে নিজেদের আদর্শ লুকিয়ে রাখে।

হিন্দু শব্দটিই বেদ, উপনিষদ, গীতা বা মনুস্মৃতির মত পবিত্র হিন্দু গ্রন্থগুলিতে নেই। শব্দটি চালু করেছিল সিন্ধু নদের পশ্চিম দিক থেকে আসা মানুষেরা, যাদের ভাষায় স-এর ব্যবহার সীমিত এবং স-এর উচ্চারণ হ-এর মত। ফলে সিন্ধু হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু

 

হিন্দুধর্ম যেহেতু পয়গম্বর বা দেবদূতভিত্তিক ধর্ম নয়, সেহেতু একই কথার বহুরকম ব্যাখ্যা চালু আছে। হিন্দু শব্দটিই বেদ, উপনিষদ, গীতা বা মনুস্মৃতির মত পবিত্র হিন্দু গ্রন্থগুলিতে নেই। শব্দটি চালু করেছিল সিন্ধু নদের পশ্চিম দিক থেকে আসা মানুষেরা, যাদের ভাষায় স-এর ব্যবহার সীমিত এবং স-এর উচ্চারণ হ-এর মত। ফলে সিন্ধু হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু এবং প্রাথমিকভাবে ওই শব্দের দ্বারা বোঝানো হত সিন্ধু নদ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে। এই অঞ্চলে প্রধানত যেসব ধর্মীয় প্রবণতা সেইসময় থেকে প্রচলিত ছিল সেগুলি হল বৈদিক ধর্ম (যাকে ব্রাহ্মণ্যবাদও বলা চলে), আজীবিক, তন্ত্র, নাথ, শৈব, বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্ম।

পরে হিন্দু শব্দটি এই এলাকায় প্রচলিত আলাদা আলাদা ধর্মীয় প্রবণতাকে (বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম ছাড়া) একত্রে বোঝানোর মত একটি শব্দ হয়ে দাঁড়ায়। ব্রাহ্মণ্যবাদ বাদে অন্য প্রবণতাগুলিকে বলা হত শ্রমণবাদ। ব্রাহ্মণ্যবাদ আর শ্রমণবাদের মূল পার্থক্য হল, প্রথমটিতে বর্ণভিত্তিক এবং লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতার বিন্যাস ছিল। হিন্দুধর্ম শব্দটির উৎপত্তির চমৎকার ব্যাখ্যা করেছিলেন ডিএন ঝা, ২০০৬ সালের ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসে তাঁর সভাপতির ভাষণে। তিনি দেখিয়ে দেন যে ‘অবশ্যই প্রাক-উপনিবেশ ভারতে শব্দটির ব্যবহার ছিল, কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শেষদিক বা উনিশ শতকের প্রথম ভাগের আগে নয় ব্রিটিশ পণ্ডিতরা এই শব্দটি গ্রহণ করেননি।’ তা হওয়ার পর থেকেই এর ব্যাপক ব্যবহার আরম্ভ হয়। তখন থেকেই এই উপমহাদেশের শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, মুসলমান ও খ্রিস্টান ছাড়া সকলের জন্যই ঐ শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে।

যেহেতু কোনো উঁচু পাঁচিল তোলা ছিল না, সেহেতু ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারা বেদ ও মনুস্মৃতিকে পবিত্র গ্রন্থ হিসাবে তুলে ধরে। হিন্দুধর্ম সম্পর্কে প্রধান দৃষ্টিভঙ্গিগুলিরও বৈচিত্র্য ছিল। আম্বেদকরের মতে হিন্দুধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যা আসলে বর্ণাশ্রম। সেই কারণেই তিনি মনুস্মৃতি পুড়িয়েছিলেন। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী নিজেকে বলতেন সনাতনী হিন্দু এবং ইয়াং ইন্ডিয়া-তে ৬ অক্টোবর ১৯২১ তারিখে লেখেন ‘হিন্দুধর্ম সকলকে নিজের বিশ্বাস বা ধর্ম অনুযায়ী ঈশ্বরের উপাসনা করতে বলে, তাই সমস্ত ধর্মের সঙ্গেই শান্তিতে বসবাস করে।’ আন্তঃধর্ম সম্পর্ক এবং বহুত্ববাদের এ এক অনন্য ধারণা। এখন রাহুল হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে সত্য, প্রেম এবং অহিংসাকেই হিন্দুধর্মে প্রাণ বলে গণ্য করছেন।

অবশ্যই প্রাক-উপনিবেশ ভারতে শব্দটির ব্যবহার ছিল, কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শেষদিক বা উনিশ শতকের প্রথম ভাগের আগে নয় ব্রিটিশ পণ্ডিতরা এই শব্দটি গ্রহণ করেননি। তা হওয়ার পর থেকেই এর ব্যাপক ব্যবহার আরম্ভ হয়।

 

হিন্দুত্ব শব্দটি চালু করেন চন্দ্রনাথ বসু, ১৮৯২ সালে। তিনি একে আধ্যাত্মিক উচ্চতা অর্জন করার সঙ্গে যুক্ত করেন। রাজনৈতিক পরিসরে হিন্দুত্ব শব্দটিকে নিয়ে আসেন এবং সংজ্ঞায়িত করেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর, এসেনশিয়ালস অফ হিন্দুত্ব (১৯২৩) বইতে। তাঁর হিন্দুত্বের ভিত্তি হল আর্য জাতি, পবিত্র ভূমি (সিন্ধু নদ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত) এবং সংস্কৃতি (ব্রাহ্মণ্যবাদী)। সাভারকর বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসার অতি বড় সমালোচক ছিলেন সেটিকেই এবং ভারতের দুর্বলতার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করতেন। এটি ইতিহাসের অত্যন্ত গোলমেলে পাঠ। কারণ বৌদ্ধ ধর্ম যখন ভারতে তুঙ্গে, তখন আধুনিক অর্থে দেশ বলতে যা বোঝায় তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। যদি আমরা সাম্রাজ্যগুলিকেও দেশ বলে ধরি, মনে রাখতে হবে, সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তখন তাঁর সাম্রাজ্য প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল। তিনি হিন্দু বলতে বুঝিয়েছিলেন এমন একজনকে যে এই ভূমিকে নিজের পিতৃভূমি এবং পবিত্র ভূমি বলে গণ্য করে।

আরএসএস সাভারকরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মকে বিদেশি ধর্ম বলে এবং প্রাচীন গ্রন্থগুলিকে (যেমন মনুস্মৃতি) মান্য বলে তুলে ধরে। আরএসএস হিংসাকে নিজেদের বিশ্বাসের অঙ্গ করে তুলেছে এবং তাদের সদর দফতরে নানারকম অস্ত্রশস্ত্র রাখা আছে। দশেরায় সেগুলির পুজো করা হয়। আরএসএস শাখাগুলি বখতিয়ার ও আলাউদ্দিন খিলজি, বাবর, ঔরঙ্গজেবের মত মুসলমান রাজাদের খলনায়ক হিসাবে তুলে ধরে এবং রাণাপ্রতাপ, শিবাজি ও পৃথ্বীরাজ চৌহানের মত হিন্দু রাজাদের নায়ক হিসাবে দেখিয়ে ঘৃণা ছড়ানোর কাজ করেছে। এই সংগঠন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও সমালোচক, কারণ তাতে সব ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। আরএসএসের দাবি হল, তারা হিন্দুদের প্রতিনিধি কারণ তারা মন্দির ধ্বংস, গোমাংস খাওয়া এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরের মত আবেগপ্রবণ বিষয় নিয়ে কথা বলে। আরএসএস প্রচারিত ঘৃণার দিকে আঙুল তুলেছিলেন স্বয়ং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, যখন ১৯৪৮ সালে তিনি বলেন ‘ওদের সমস্ত বক্তৃতা সাম্প্রদায়িক বিষে ভর্তি ছিল। সেই বিষের চূড়ান্ত ফলাফল হিসাবে দেশকে গান্ধীজির অমূল্য জীবন আহুতি দিতে হল (All their speeches were full of communal poison, as a final result of the poison, the country had to suffer the sacrifice of the invaluable life of Gandhiji)।’

সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তখন তাঁর সাম্রাজ্য প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল। তিনি হিন্দু বলতে বুঝিয়েছিলেন এমন একজনকে যে এই ভূমিকে নিজের পিতৃভূমি এবং পবিত্র ভূমি বলে গণ্য করে।

 

মহাত্মা আর রাহুলের মত নেতারা যেখানে হিন্দুধর্মের মানবিক দিকগুলিকে আরও প্রসারিত এবং বর্ধিত রূপ দিয়েছেন, সেখানে সাভারকর-আরএসএস ঘৃণা এবং তার ফলস্বরূপ হিংসার পথে হেঁটেছে। একদিকে আম্বেদকর হিন্দু জীবনচর্যার উপর ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্যের বিরোধিতা করেছেন, অন্যদিকে মহাত্মা থেকে রাহুল পর্যন্ত অনেকে হিন্দুধর্মে এক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অহিংস অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

 

এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি অনুবাদ।

 

spot_img

Related articles

How Do You Kill a Case? The UP Government’s Playbook in the Akhlaq Lynching

Ten years. Ten whole years since a mob dragged Mohammad Akhlaq out of his home in Dadri, beat him...

Why Indira Gandhi Remains India’s Most Influential and Most Debated Prime Minister

Let us recall the achievements of Indira Gandhi, whose birth anniversary we celebrate today. She has undoubtedly been...

नेताओं ने झारखंड की ज़मीन, जनता के हक़ के बदले सौंप दी कंपनियों को- झारखंड जनाधिकार महासभा

झारखंड अपनी 25वीं वर्षगांठ मना रहा है, लेकिन झारखंड आंदोलन के सपने पहले से कहीं ज़्यादा दूर हैं।...

El Fashir Has Fallen — and So Has the World’s Conscience on Sudan

The seizure of the city of El Fashir in North Darfur by the paramilitary Rapid Support Forces (RSF)...