“চন্দ্রা। কতদিনে তোমাদের কাজ ফুরবে?
বিশু। পাঁজিতে তো দিনের শেষ লেখে না। একদিনের পর দুদিন, দুদিনের পর তিনদিন; সুড়ঙ্গ কেটেই চলেছি, এক হাতের পর দু হাত, দু হাতের পর তিন হাত। তাল তাল সোনা তুলে আনছি, এক তালের পর দু তাল, দু তালের পর তিন তাল। যক্ষপুরে অঙ্কের পর অঙ্ক সার বেঁধে চলেছে, কোনো অর্থে পৌঁছয় না। তাই ওদের কাছে আমরা মানুষ নই, কেবল সংখ্যা। ফাগুভাই, তুমি কোন সংখ্যা।
ফাগুলাল। পিঠের কাপড়ে দাগা আছে, আমি ৪৭ফ।
বিশু। আমি ৬৯ঙ। গাঁয়ে ছিলুম মানুষ, এখানে হয়েছি দশ পঁচিশের ছক। বুকের উপর দিয়ে জুয়োখেলা চলছে।
চন্দ্রা। বেয়াই, ওদের সোনা তো অনেক জমল, আরো কি দরকার”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে ‘রক্তকরবী’ বলে একটি নাটক লিখেছিলেন। ওপরের সংলাপটি তাঁরই অংশ বিশেষ। আজ থেকে একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যা দেখতে পেয়েছিলেন, এবং সেটাকে তাঁর লেখায় যেভাবে দেখিয়েছিলেন তা আজকে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আজকের মানুষের আর কোনও পরিচিতি নেই, প্রত্যেকেই এক একটি সংখ্যা। রাষ্ট্রের ইচ্ছায় সে জীবিত, রাষ্ট্রের ইচ্ছায় সে মৃত। এডওয়ার্ড স্নোডেন, কয়েক বছর আগে এই কথাটাই বলেছিলেন, যে ভারতবর্ষের আধার প্রকল্প মানুষকে তাঁর পরিচিতি ছিনিয়ে নিয়ে দাস বানাবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা তথা দেশের বহু মানুষের কাছে ইউআইডিএআইয়ের চিঠির প্ররিপ্রেক্ষিতে এই কথাগুলো আরো জোরের সঙ্গে কি বলা উচিৎ নয়?
চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেছে। আধার কতৃপক্ষ অর্থাৎ ইউআইডিএআইয়ের কাছ থেকে চিঠি পাচ্ছেন অনেকেই, তাঁদের আধার ডিঅ্যাক্টিভেট অর্থাৎ অচল করে দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, যেহেতু এই মানুষেরা ভারতে বসবাস করার শর্ত পূরণ করতে পারেননি, তাই তাঁদের ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই চিঠি, যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা এবার অকুল পাথারে পড়েছেন, কোথায় যাবেন, কার কাছে গেলে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে, তাঁরা বুঝতেই পারছেন না। রাজনীতির মানুষজন ও মাঠে নেমে পড়েছেন। কেন্দ্রের শাসক দলের বাংলার নেতারা তিনজন, তিন রকম বয়ান দিয়েছেন, কারো বয়ানের সঙ্গে কারো মিল নেই। বিজেপির রাজ্য সভাপতি, সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কথা হয়েছে, কোনও একজন মানুষের চিন্তার কোনও কারণ নেই, সবার আধার আবার চালু হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর, আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত মেইলে এবং ফোন নম্বরে যেন অভিযোগ জানানো হয়, তিনি একটি অভিযোগ জানানোর ফর্ম ছাপিয়েছেন, সেই ফর্ম ভর্তি করলেই সবার আধার নম্বর চালু হয়ে যাবে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, যেমন সবেতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ষড়যন্ত্র দেখতে পান, এবার ও সেটাই দেখেছেন। উনি বলেছেন, কোনও আধার কার্ড বাতিল হয়নি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি, ইউআইডিএআইয়ের রাঁচি অফিসের সঙ্গে যোগসাজশে এই চিঠি পাঠিয়েছেন। আদ্যন্ত মিথ্যে বলছেন বিরোধী দলনেতা, সারা দেশে এই ধরনের চিঠি অনেকেই পেয়েছেন। ২০২০ সালেই বেঙ্গালুরুর দু’জন যুবক এই ধরনের চিঠি পান, তাঁদের শুনানির জন্য হাজির হতে বলা হয়। ঐ জায়গায় গিয়ে তাঁরা দেখেন, তাঁদের মতো অনেকেই এই চিঠি পেয়েছিলেন। পরে হইচই হওয়াতে তখনকার মতো ইউআইডিএআই এই চিঠি পাঠানো বন্ধ করে।
যা জানা যাচ্ছে, ইউআইডিএআই আপাতত প্রায় ১ লক্ষ এই রকম চিঠি পোষ্ট করেছেন। বিজেপির অনেক নেতা এখন বলার চেষ্টা করছেন, এটা প্রযুক্তিগত বিভ্রাট। যদি সেটাও সত্যি বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, প্রযুক্তিগত বিভ্রাটের সঙ্গে ডাকবিভাগের চিঠির কী সম্পর্ক? তার মানে এটা কোনও প্রযুক্তিগত বিভ্রাট নয়, এটা সচেতন ভাবেই করা হয়েছে। বিজেপির আর এক বাংলার নেতা, অসীম সরকার তো সরাসরি বলেই দিয়েছেন, বিজেপিকে ভোট না দিলে, আরো অনেকের আধার নিস্ক্রিয় হতে পারে। তারমানে আরো বহু মানুষের নাগরিকত্ব যেতে পারে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও বলেছেন, তিনি হেল্পলাইন খুলে এই অসুবিধার কিংবা সমস্যার সমাধান করে দেবেন, কিন্তু সেটাও বাস্তব নয়। সেটা হয়তো সাময়িকভাবে কিছু স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু তা পুরো সমাধান নয়। আসলে আধার এবং নাগরিকত্ব সরাসরি যুক্ত না হলেও যুক্ত। যদিও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, আধার নাগরিকত্বের কোনও পরিচয়পত্র নয়, আধার জন্মের শংসাপত্র নয়, আধার শুধুমাত্র একটি যাচাই করার উপকরণ মাত্র, কিন্তু ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদীর আনা, আধার আইনের ২৮এ ধারায় কী বলা আছে, তা যদি একটু পড়ে নেওয়া যায়, তাহলেই বোঝা যাবে, এই ধরনের ঘটনা কিন্তু শুধুমাত্র গ্রামে গঞ্জে হবে এমনটা নয়, যে কোনওদিন যে কেউ কিন্তু এই ধরনের চিঠি পেতে পারেন। এনপিআর হচ্ছে এনআরসি অর্থাৎ নাগরিকপঞ্জীর প্রথম ধাপ। আমরা দেখেছি, আসামে এনআরসি করার ফলে, প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ বে নাগরিক হয়েছেন। এখনও কিন্তু আসামে ১৭ লক্ষ মানুষের আধার সক্রিয় হয়নি। সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলেও শোনা যাচ্ছে। আগামীদিনে এই নাগরিকপঞ্জীর কাজ খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই হয়ে যাবে, কারণ ২০১৫ সালে যখন আধার হালনাগাদ হয়েছিল, তখনই এনপিআর করা হয়ে গিয়েছিল বেশীরভাগ মানুষের। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই ক্রোনোলজি বোঝানো ভিডিওটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, সিএএ অর্থাৎ নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে এনআরসি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এনপিআরের সঙ্গে আধারের কী সম্পর্ক, তা যদি আন্দাজ করা যায় তাহলে যে কেউই ভয় পেয়ে যাবেন। তখন কী করবেন, তা কিন্তু সেই ব্যক্তির সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখনই একজোট হওয়ার সময়, বলার সময়, আমরা আধার মানিনা, আমরা কোথাও আধার দেবো না। সরকারি পরিষেবা আমাদের অন্য যে কোনও পরিচিতি দেখেই দিতে হবে। মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ধরনের একটি পরিচয়পত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করাই ছিল, তাঁর আন্দোলনের পদ্ধতি। নাগরিক সমাজ যদি এই আধার ধ্বংসের আওয়াজ না তোলে, এবং বলে আমাদের ভোটে যে সরকার নির্বাচিত, তা আমাদের কি করে বে নাগরিক করতে পারে একটি সুইচ অফ করে, এবং সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন না করে এবং রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তিরা যদি এই সমস্যাটার গভীরে না যান, তাহলে সামনে সমূহ বিপদ।
ইংরেজিতেও আধার নিষ্ক্রিয়করণের উপর eNewsroom-এর অংশ পড়ুন